প্রশ্ন: বাংলা কাব্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর: রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রাবস্থায় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর এর পাতায় আয়োজিত "কালেজীয় যুবকদের কবিতা যুদ্ধ"তে একজন যোদ্ধা ছিলেন তিনি। তিনি প্রথম বাংলা সাহিত্যে পালাবদলের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষা তাঁকে ঠিক বুঝিয়েছিলো যে, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ শেষ হয়ে গেছে, এমনকি ঈশ্বরগুপ্তের যুগ বিদায় নিতে চলেছে। তার পরিবর্তে আসছে নতুন যুগ। রঙ্গলাল ইংরেজি সাহিত্যের পন্ডিত ছিলেন। প্রথমদিকে এডুকেশন গেজেট সম্পাদনা করেছিলেন এবং বাংলা সাহিত্য নিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। 'বাংলা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ' রচনায় ইংরেজি ও বাংলা কাব্যের তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তখন দেশে সবেমাত্র স্বদেশ প্রেম ও স্বদেশ চেতনার অস্পষ্ট উন্মেষ দেখা দিয়েছিল। সেই আমলে রঙ্গলাল ইতিহাস ও স্বদেশ প্রেমকে অবলম্বন করে কয়েকটি কাব্য লিখেছিলেন। কাব্যগুলি হল, " পদ্মিনী উপাখ্যান" (1858 খ্রিস্টাব্দে), " কর্মদেবী" (1862), " সুরসুন্দরী" (1868), " কাঞ্চী কাবেরী" (1879)। এছাড়াও তিনি কুমারসম্ভবের কিছুটা অনুবাদ করেছিলেন, কিছু ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন।
রঙ্গলাল উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কবিতার ধরনের টমাস মূর, বায়রন, স্কট- এদের আদর্শে দেশপ্রেম ও ইতিহাসকে অবলম্বন করে টডের রাজস্থান কাহিনী থেকে কাহিনী নিয়ে লিখলেন "পদ্মিনী উপাখ্যান"। টডের রাজস্থান গ্রন্থে সুলতান আলাউদ্দিন কর্তৃক চিতোর অবরোধ এবং সতীত্ব রক্ষার জন্য পদ্মিনীর জহর ব্রত পালন করে প্রাণ বিসর্জন-এর কাহিনী আছে। রঙ্গলাল সেই উদ্দীপনাময় কাহিনীটি কে গ্রহণ করে সৌর্য বীর্যময় এক কাহিনী লিখলেন তাঁর " পদ্মিনী উপাখ্যান" কাব্যে। এই কাব্যে যে বলিষ্ঠ জীবনের প্রতিধ্বনি' ধ্বনিত হয়েছে তা ঈশ্বরগুপ্তের যুগে অকল্পনীয় ছিল। রঙ্গলাল হয়তো কবি হিসাবে বিরাট কিছু করে যেতে পারেননি, কিন্তু কাব্যের বিষয় নির্বাচনে এক নতুন আবির্ভাবের মঙ্গলধ্বনি বাজিয়েছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা সাহিত্যে পরাধীনতার জ্বালা অনুভব করে স্বাধীনতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। " পদ্মিনী উপাখ্যান" কাব্যে রানা ভীমসিংহের কন্ঠে গীত স্বাধীনতা সংগীত একদা বাংলার স্বাধীনতা মন্ত্রের উদ্বোধন রূপে পাঠকের কন্ঠে কন্ঠে ফিরেছে। -
" স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়? "
এটি টমাস মুর এর কবিতা অবলম্বনে রচিত। এর মধ্যে বাঙালি প্রথম তার জাতীয় জীবনের জাগরণ মন্ত্র শুনেছে। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে, তখনো বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন আসেননি, ঈশ্বরগুপ্তের প্রভাব তখনও বাংলা কাব্যে লুপ্ত হয় নি। তাই এই অবস্থায় রঙ্গলাল এর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
তাঁর পরবর্তী কাব্য " কর্মদেবী" যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন বাংলা কাব্যে মধুসূদন সগৌরবে এসে গেছেন। তাই রঙ্গলাল পাঠকের মনে আর উল্লেখযোগ্য প্রভাব সৃষ্টি করতে পারলেন না। কর্মদেবীর চার সর্গময় কাহিনীসূত্র রাজপুত ইতিহাস থেকে নেওয়া হয়েছে। স্যার ওয়াল্টার স্কট এর রচনায় যেমন ইতিহাস ও রোমান্স মিশ্রিত হয়েছে, তেমনি 'কর্মদেবী'ও ইতিহাস ও রোমান্সের আশ্রয়ে সৃষ্টি হয়েছে।
তাঁর তৃতীয় কাব্য " শূরসুন্দরী"। এটিও রাজপুত ইতিহাস থেকে নেওয়া হয়েছে। রানা প্রতাপের যুগে রাজস্থানের বীর রমণীদের সতীত্ব ও মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে এই কাব্যে। তবে কাব্য হিসাবে এটি ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর শেষ কাব্য " কাঞ্চী কাবেরী"। রঙ্গলাল কিছুদিন উড়িষ্যায় সরকারি কাজ করেছিলেন। উড়িয়া ভাষা জানতেন তিনি। মনে রাখতে হবে, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম উড়িয়া ভাষায় মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। উড়িষ্যার এক জনপ্রিয় কাহিনীকে অবলম্বন করে তাঁর কাঞ্চী কাবেরী লেখা হয়েছিল। কাব্যটি সুখপাঠ্য।
রঙ্গলাল এর কবি প্রতিভা সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর কৃতিত্বের কথা মনে রেখেও বলা যায়, আধুনিক জীবনের নতুন তরঙ্গ উচ্ছ্বাস তাঁকে বিচলিত করেছিল, কিন্তু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বরং নবজাগরণের নবজীবনের নতুন গতিবেগকে তিনি বাঁধাধরা প্রচলিত পথে পয়ার, ত্রিপদী ছন্দে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ নব উপলব্ধির বাহ্যিক দিকটা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু আত্মার গভীরে সেই উপলব্ধি এসে পৌঁছায়নি। তাই কি শব্দ প্রয়োগে, কাব্যের সাজসজ্জায়, কোনোদিক থেকেই তিনি আগন্তুক জীবনকে ধরতে পারেননি। বরং বলে নেওয়া ভালো, তিনি ইতিহাস, স্বদেশ প্রেম আর রোমান্সকে নিয়ে পুরনো ধাঁচের দীর্ঘ আখ্যান কাব্য লিখেছিলেন। মধুসূদনের মত সমগ্র সত্তাকে দিয়ে রেনেসাঁসকে অনুভব করতে পারেননি। তবুও সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে স্বল্প প্রতিভা নিয়ে রঙ্গলাল বাংলা কাব্যে একজন স্মরণীয় কবি ব্যক্তিত্ব।
।।সমাপ্ত।।
#BANGLA SAHITYER ITIHAS
#RANGALAL BANDYOPADHAY