লোকটা জানলই না
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায় হায়
লোকটার ইহকাল পরকাল গেল।
অথচ
আর একটু নিচে
হাত দিলেই সে পেত
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ
তার হৃদয়
লোকটা জানলই না।
তার কড়িগাছে কড়ি হল
লক্ষ্মী এলেন
রণ পায়ে।
দেয়াল দিল পাহাড়া
ছোটলোক হাওয়া
যেন ঢুকতে না পারে।
তারপর
একদিন গোগ্রাসে গিলতে গিলতে
দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে
কখন
খসে পরলো তার জীবন
লোকটা জানলই না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার মধ্যে সাধারণ মানুষের কথা ও সমাজের কথা বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। মানুষের স্বার্থপরতা, নীচতা, সমাজের কদর্য রূপ তাঁর কবিতায় যেমন আছে তেমনি ভাবে শেষ পর্যন্ত মানুষের উপরে তিনি আস্থা রেখেছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনকে বিশ্লেষন করেছেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, করতেন হাতে হাত রেখে মানুষ একদিন এই সমাজ ও দেশকে শান্তির আশ্রয়স্থল করে তুলবে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানুষের কবি, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শোষনহীন এবং উন্নততর এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা "লোকটা জানলই না" কবিতাটি তাঁর "শ্রেষ্ঠ কবিতা" কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
এই কবিতায় তিনি স্বার্থসর্বস্ব মানুষের জীবনের অর্থহীনতার পরিচয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। অর্থ উপার্জনের বাসনায় মানুষ কেবলই ছুটে চলেছে। অর্থ উপার্জনে মত্ত থেকে মানুষ ভুলে যায় জীবনের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য। অথচ, অর্থের চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে জীবনকে উপভোগ করতে জানলে মানুষ বুঝতে পারত জীবন অমূল্য।
কবিতার প্রথমে আছে,
"বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায় হায়
লোকটার ইহকাল পরকাল গেল।"
এখানে বুকপকেট বলতে জামার উপরে বাম দিকে টাকাপয়সা রাখার জন্য যে পকেটে থাকে, সেই স্থানকে বলা হয়েছে। এ কথার মধ্য দিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানুষের অর্থের প্রতি লোভকে প্রকাশ করেছেন। সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা সারা জীবন টাকা পয়সার হিসাব নিকাশ জীবন কাটিয়ে দিলেন। টাকা পয়সা ছাড়া জীবনের অন্য অর্থ আছে তা তারা বুঝলেন না। অর্থ সর্বস্ব মানুষগুলি অর্থ উপার্জনের নেশায় জীবনের প্রকৃত আনন্দ ভোগ করতে পারলে না। তাই তোদের ইহকাল গেল। ইহকাল শব্দের অর্থ পার্থিব জীবন। একসঙ্গে তাদের পরকালও নষ্ট হল। অর্থের হিসাব করতে ব্যস্ত মানুষ পৃথিবীতে এমন কোন ভাল কাজ করে যেতে পারেন না যা তার মৃত্যুর পরে থাকবে। জীবনে কোন মহৎ কর্ম সাধনের মধ্য দিয়ে মানুষ মৃত্যুর পরেও অমর হয়ে থাকেন। কিন্তু সুযোগসন্ধানী মানুষটি বা মানুষরা তেমন কোনো কর্ম করতে পারেন না বলে তাদের পরকাল নষ্ট হল।
এরপরে আছে,
"অথচ
আরেকটু নিচে
হাত দিলেই সে পেত
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ
তার হৃদয়
লোকটা জানলই না।"
অর্থাৎ ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে মানুষের উচিত হৃদয়ের ধর্ম পালন করা। পকেট এর নিচে আছে হৃদয়। পকেটের সুখের বদলে হৃদয়ের সুখ প্রধান কামনার বস্তু হওয়া উচিত। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হল রূপকথার গল্পের প্রসঙ্গ বিশেষ। রূপকথার গল্পে আছে আলাদিনের কাছে একটি প্রদীপ ছিল, যা তার সব মনস্কামনা পূর্ণ করে দিত। তেমনি ভাবে মানুষের হৃদয় হল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, যা তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে। জীবনকে যথার্থভাবে উপভোগ করতে হলে প্রথমে হৃদয়ের দাবিকে পূর্ণ করতে হবে। জীবন অমূল্য, তুচ্ছ অর্থ চিন্তা করে এই অমূল্য জীবনকে নষ্ট করা উচিত নয়। অথচ স্বার্থমগ্ন মানুষ এই সরল সত্য কথাটি বুঝলো না।
কবিতায় এরপরে আছে,
"তার কড়ি গাছে কড়ি হলো
লক্ষ্মী এলেন
রন-পায়ে।"
অর্থাৎ অর্থের সাধনা করতে করতে মানুষ একদিন অর্থ লাভ করল। লক্ষ্মী হলেন সম্পদের দেবী। বাঁ দিকের বুক পকেটে সামলাতে সামলাতে মানুষ সম্পদ অর্জন করলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত সুখ পেল না। কড়ি গাছে কড়ি হল এবং লক্ষ্মী এলেন এই কথা দুটির মাধ্যমে তার সম্পদ লাভের এবং বড়লোক হয়ে ওঠার কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলেও জীবনের আকাঙ্ক্ষা যে মিটলো না সে কথা কবি বুঝিয়েছেন, লক্ষ্মী দেবীর রনপায়ে আসার ব্যঞ্জনায়।
এরপর আছে,
" দেয়াল দিল পাহাড়া
ছোটলোক হাওয়া
যেন ঢুকতে না পারে। "
অর্থাৎ, সম্পদ অর্জন করার পর মানুষ আরো বেশী স্বার্থমগ্ন হয়ে পড়ল। অর্থ এবং সম্পদ উপভোগ করতে সাহায্য করে। কিন্তু মানুষটি জীবনকে উপভোগ করার জন্য সম্পদ অর্জন করে নাই। লক্ষ্মী দেবীকে চারদিকে দেওয়াল তুলে বন্দী করে রাখল। সমাজে তৈরি হলো শ্রেণী বিভাজন। কিছু মানুষ সম্পদকে নিজেদের অধিকারে রেখে সমাজে কৃত্রিম অভাব তৈরি করল। আর কিছু মানুষ সম্পদের অভাবে খাদ্যহীন, বাসস্থানহীন হয়ে জীবনের যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকলো। এই অসমতা কখনো কাম্য হতে পারে না। পৃথিবীর সম্পদে সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু, পৃথিবীর ইতিহাস হল বঞ্চনার ইতিহাস। বিত্তবান মানুষরা মানুষকে ঘৃণা করে ও বঞ্চনা করে নিজেদের ইহকাল ও পরকাল যেমন নষ্ট করল, তেমনই অন্যান্য মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
এরপরে আছে,
" একদিন গোগ্রাসে গিলতে গিলতে
দু আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে
কখন
খসে পড়ল তার জীবন
লোকটা জানলই না। "
গোগ্রাসে খাওয়ার অর্থ গরুর মত না চিবিয়ে গিলে খাওয়া। গোগ্রাসে খাওয়ায় কোন স্বাদ থাকে না। বিত্তবান মানুষরা তেমনি জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পারেনা। মানুষকে বঞ্চনা করে স্বার্থপর মানুষেরা যে অর্থ উপার্জন করে, তাতে জীবনের দাবি মেটেনা। আজকে ভালোবেসে মানুষের পাশে থাকার মধ্যে প্রকৃত আনন্দ লুকিয়ে আছে। মানুষের সেবায় আত্মত্যাগ করলে তবে প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু অর্থের লোভে অন্ধ মানুষরা এই সত্য কথাটি বুঝতে পারল না। অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়তে গড়তে একদিন তার অমূল্য জীবন খসে পড়ল, অর্থাৎ মৃত্যু হলো তার। স্বার্থপর মানুষের মৃত্যুতে গৌরব থাকেনা। দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে জীবন খসে পড়ার অর্থ কোন উদ্দেশ্যহীনভাবে মরে যাওয়া। দু আঙ্গুল দিয়ে টাকা গুনতে গুনতে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে কখন যে মহা মূল্যবান জীবন খসে পড়ে তার হিসাব রাখে না সে। অথচ অর্থের চিন্তায় মগ্ন না থেকে, মানুষের পাশে থেকে হৃদয়ের দাবী কে পূর্ণ করলে তার ইহকাল এবং পরকাল উজ্জ্বল হতে পারত। তা সে করল না।
কবিতাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একজন স্বার্থপর মানুষের ছবি এঁকেছে। জীবনে প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম একজন মানুষ কিভাবে নিজেকে ঠকায় এবং দেশ ও সমাজের দুঃখের কারণ হয় তার ছবি আছে এই কবিতায়। মানুষটি জীবনের সুখ বলে সারা জীবন অর্থ চিন্তা করে গেল, অর্থ উপার্জন করল, কিন্তু জীবন তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। লোকটি জানলোই না কিভাবে জীবন উপভোগ করতে হয়। কবিতার নাম "লোকটা জানলই না" কবিতার প্রকৃত ব্যঞ্জনাটিকে সার্থকভাবে উপস্থাপন করেছে। তাই কবিতার নামটি যথার্থ হয়েছে।
সমাপ্ত।
#সুভাষ_মুখোপাধ্যায় #বাংলা_কবিতা