দ্বিজেন্দ্রলাল রায় Dijendralal Roy

বাংলা সাহিত্য আলোচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আধুনিক যুগ 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়


বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কৃতিত্ব :


কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(1863- 1913) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা নাট্য সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা নাট্যকার ছিলেন আবেগপূর্ণ ভাষায় রচিত তার স্বদেশ প্রেমমূলক ঐতিহাসিক নাটকগুলি এখনো বেশ জনপ্রিয়  এই শতাব্দীতে এসে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে,লোক উৎসবে, থিয়েটারে, লোকেরা দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলি উৎসাহের সঙ্গে অভিনয় করেন এবং এখনো দর্শকচিত্ত আবেগমথিত হ । যেখানে মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্রের কোন নাটক অভিনয় খবর পাওয়া যায় না বা গিরিশচন্দ্রের দু-একটি নাটক ছাড়া অন্য নাটক অভিনয়ে সংবাদ পাওয়া যায় ন, সেখানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক অভিনয়ের সংবাদ নাট্যকারের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে  অভিনয় যোগ্যতার বিচারে রঙ্গমঞ্চের ত্রুটিপূর্ণ অভিনয় নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বাঙালি মনের আবেগ ও দেশপ্রেমের ঐকান্তিক আবেগমূলক ভাষা তাঁর নাটকগুলি উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল  তার জনপ্রিয়তার কারণে অনেকে তাকে মুকুটহীন সম্রাট আখ্যা দিয়েছেন ।

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও কিছুকাল ইউরোপে বাস করে ইংরেজি নাটক দেখা ও চর্চার ফলে দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যচিন্তা অনেকটা পরিণতি লাভ করেছিল  নাটকে বিশুদ্ধ পাশ্চাত্য আঙ্গিক অনুসরণের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল তার মনে  তথ্যগতভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইবসেনর অনুকরণে তিনি নাটক থেকে স্বগোতক্তি তুলে দেন  উচ্চশিক্ষা, নাটক সম্পর্কে বোধ, নাট্যসাহিত্য চর্চা তাকে নাটক রচনায় সাহায্য করেছে  ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দ্বন্দ্বমুখর নাটকীয়তায় ভরা প্রাচীন যুগের ও মধ্যযুগের মুঘল আমলের ভারতবর্ষে কাহিনীকে তিনি নাটকের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন   ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, বিশ্বাসঘাতকত, ক্ষমতা বিস্তারের সংঘর্ষ, মানব মনের বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার টানাপোড়েন তার নাটকে শৈল্পিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে  ইতিহাস ও কল্পনাকে যথাযথভাবে মিশ্রিত করে তিনি যে ঐতিহাসিক নাটকগুলি লিখেছিলেন, সেখানে কিছু বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও সেগুলির সাহিত্যগুণ ক্ষুণ্ণ হয়নি ।

দ্বিজেন্দ্রলাল ছোট-ছোট তাৎপর্যপূর্ণ সংলাপ রচনা করেছেন  কিন্তু তার ভাষার তীব্র আবেগ, প্রচন্ড গতি ও দীর্ঘ সংলাপের ক্লান্তিকর বক্ততাকে ভুলিয়ে দিয়েছে দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাস  ভাষার এই মাধুর্য সৃষ্টি করে তিনি নাট্য কাহিনীকে চিত্তাকর্ষক করে তুলেছেন  দীর্ঘ সংলাপ যে কত জীবন্ত হতে পারে তা আমরা দেখেছি সাজাহান নাটকের বিখ্যাত দরবার দৃশ্য ঔরঙ্গজেব ও জাহানারার সংলাপ এবং চন্দ্রগুপ্ত নাটক চাণক্যর চরিত্রে ।

দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক সংগীত প্রয়োগের নৈপুণ্য আমাদের মুগ্ধ করে  বাংলা নাটকের প্রথম পর্ব অপেরা ও যাত্রা সংগীতের প্রয়োগ ছিল বেশি  যদিও সেখানে সংগীত শুধু চিত্ত বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতো, নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও নাট্য গতির সাথে তার যোগ্য ছিল না । কিন্তু, সঙ্গীতকে নাটকের ভাববস্তুর সঙ্গে এত নিবিড় ভাবে যুক্ত করতে তার পূর্বে আর কেউ চেষ্টা করেননি  তার বেশিরভাগ সংগীত নাট্য চরিত্রের মানসিকতা বোঝাতে বা নাটকের পরিবেশকে স্পষ্ট করতে ব্যবহার করেছেন তিনি  তার নাটকে ব্যবহৃত অনেক গান আজও বাঙালির দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ সংগীত  যেমন,
 ধনধান্যে পুষ্পে ভরা
 কিংবা, যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ ।
 এই সংগীতগুলি আজও সমান জনপ্রিয়  তিনি একজন নাট্যকার ছাড়াও একজন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতকার ছিলেন  সুর ও বাণী তার গানগুলিকে তাই অসামান্য করেছে ।

রঙ্গ-ব্যাঙ্গ, প্রহস, সামাজিক ও পৌরাণিক ইত্যাদি নানা প্রকার নাটক লিখেছিলেন তিনি  যদিও তাঁর খ্যাতি মূলত ঐতিহাসিক নাটকগুলি নিয়ে  প্রথম জীবনে তিনি কয়েকটি প্রহসন নিয়ে নাট্যজগতে এসেছিলেন  সেগুলো হল, কল্কি অবতার(1895), বিরহ(1897), ত্রহস্পর্শ(1900), প্রায়শ্চিত্ত(1901), পুনর্জন্ম(1911), আনন্দ বিদায়(1912) । এই প্রহসনগুলি খুব উঁচুদরের রচনা হয়নি  আনন্দ বিদায় সংক্ষিপ্ত রূপ প্রথমে বঙ্গবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল(1902) পরে গ্রন্থাকারে পরিবর্তিত হয়  লেখক বইটিকে প্যারোডি বলেছিলেন । কিন্তু, এটা আসলে তীব্র ব্যক্তিগত স্যাটায়ার  আজন্ম রবীন্দ্র-বিরোধী দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুরবাড়ির প্রতি ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি অকারণে বিদ্বেষবিষ উদগীরণ করেছেন  স্টার থিয়েটারে অভিনয়কলে শিক্ষিত দর্শক উত্তেজিত হয়ে অভিনয় ভেঙে দেন  প্লট ভালো নয়, রুচি সর্বত্র শোভন নয় ।

দ্বিজেন্দ্রলাল পৌরাণিক আবহাওয়াকে অস্বীকার করতে পারেননি  তাপাষাণী(1900) সীতা’(1908), ভীষ্ম(1914) ইত্যাদি নাটকগুলোতে পৌরাণিক কাহিনীক নতুন ভাবে উত্থাপন করার চেষ্টা দেখা যায়  নাটকীয় অভিনয় যোগ্যতায় এগুলি বিশেষ ঐশ্বর্যবান নয় ।

উনিশ শতকের সমাজ জীবনকে নিয়ে তিনি দুটি সামাজিক নাটক লিখেছিলেন- পরপারে’(1912) এবং বঙ্গনারী’(1016)  ইতিবৃত্ত ইতিহাসমূলক রোমান্টিক কাহিনী অবলম্বন করে তিনি দুটি মেলোড্রামা ধরনের নাট্যকাব্য লিখেছিলেন অংশত অমিত্রাক্ষর ছন্দে  তারাবাঈ(1903) এবং সোরাব রুস্তম(19008) ।

দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা তার ঐতিহাসিক নাটকগুলির জন্য  তিনি প্রধানত মুঘল ও প্রাচীন হিন্দু যুগের কাহিনী নিয়ে তার ঐতিহাসিক নাটকগুলি লিখেছিলে । মুঘল যুগের ইতিহাস সাম্রাজ্যের দ্বন্দ্বে রক্তরঞ্জিত, ভ্রাতৃঘাতী ও পিতৃঘাত কোলাহলে উচ্চকিত । সেই যুগের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটকগুলি- দুর্গাদাস(1905), প্রতাপসিংহ(1905), নুরজাহান(1908), মেবার পতন(1908), শাজাহান(1909) তিনি হিন্দু যুগের কাহিনী নিয়ে দুখানি নাটক রচনা করলেন চন্দ্রগুপ্ত(1911) এবং সিংহল বিজয়(1915)  ইতিহাসের ঘাতসংঘাত, তরবারি ঝংকার ও ষড়যন্ত্রর মধ্যে রোমাঞ্চ আছে  তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে এই নাটকগুলি লেখা । শাজাহান পিতৃসত্তার সঙ্গে সম্রাট সত্তার দ্বন্দ্ব, নুরজাহানে ক্ষমতালিপ্সার সঙ্গে মাতৃত্বের দ্বন্দ্ব চমৎকার ফুটে উঠেছে  জীবনের এমন বিপুল গতিবেগ, দেশপ্রেমের এমন বলিষ্ঠ প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায় নাই  অন্য প্রাদেশিক ভাষায় তার অনেক নাটক অনূদিত  হয়েছে ।

পাশ্চাত্য নাটকের ও ক্লাসিক নাটকের পঞ্চসন্ধি মান্য করে তাঁর নাটকগুলি লেখা হয়েছিল  অ্যারিস্টটল তিনটি নাট্য ঐক্যের কথা বলেছেন, এই নাটকে নাটকে তারপ্রতিফলন দেখতে পাই  নাট্যকার ইতিহাসের কাহিনীতে যেখানে যেমন প্রয়োজন, তেমন পরিবর্তন করেছেন  তার পরিবেশনার গুনে অনৈতিহাসিক কাহিনীগুলি ইতিহাস বিরোধী বলে মনে হয় না  যেটুকু বিকৃতি তার নাটকে আছে তা নাটকের নির্দেশ মেনে এবং এটুকু পরিবর্তন না করলে তার নাটকগুলি নিরস ইতিহাস হয়ে যেত । 

Previous Post
Next Post
Related Posts